প্রাণঘাতী রোগ এইডস মোকাবিলায় জাতিসংঘ ঘোষিত বৈশ্বিক ৯৫-৯৫-৯৫ লক্ষ্য অর্জনে এখনো উল্লেখযোগ্য দূরত্বে রয়েছে বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী—দেশের ৯৫% আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, শনাক্তদের ৯৫% কে চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং চিকিৎসাধীন ৯৫% রোগীর ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা—এ তিন ধাপেই পিছিয়ে আছে দেশ।
🔎 বাংলাদেশের বর্তমান অর্জন:
- রোগী শনাক্ত: মাত্র ৬৯%
- চিকিৎসার আওতায় আনা: ৭১%
- ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা: ৮৯%
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছরগুলোতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ দেশের এইচআইভি/এইডস নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বড় অংশ যে গ্লোবাল ফান্ডের ওপর নির্ভরশীল, তা ডিসেম্বরের পর থেকেই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে চলেছে।
❗ অর্থায়ন সংকট — বাড়ছে ঝুঁকি
দীর্ঘদিন ধরে ইউএসএআইডি ও বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় এইডস প্রতিরোধ, সচেতনতা এবং রোগী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হলেও, অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু এনজিও কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের অপারেশন প্ল্যান (ওপি) বাতিল হওয়ায় কেন্দ্রীয় তহবিল থেকেও আর অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে না।
ফলে অনেক এলাকায় ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে প্রতিরোধমূলক কাজ, আর আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সেবা সংকুচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা—এই পরিস্থিতিতে নতুন সংক্রমণ বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক ডা. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “ওপি বন্ধ হওয়ায় দেশে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। প্রকল্প প্রণয়ন নিয়ে দেড় বছর সময় গেলেও এখনো কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। এতে ঝুঁকি বাড়ছে।”
📈 গত তিন বছরে রেকর্ডসংখ্যক নতুন রোগী শনাক্ত
জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির তথ্য বলছে, গত তিন বছরে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বিশেষত সমকামী পুরুষ, পুরুষ যৌনকর্মী ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট:
- ২০২২: ২৪% (২৫৩ জন)
- ২০২৩: ২৯% (৩৭০ জন)
- ২০২৪: ৪২% (৬০৪ জন)
এদের বেশিরভাগের বয়স ২১ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে।
🔥 ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে
২০২০ সালের তুলনায় দেশে পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজারে।
অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী:
- হিজড়া: ১২,৬২৯ জন (সেবা পাচ্ছেন ৫৫%)
- শিরায় মাদকসেবী: ৩৪,৩৭০ জন (চিকিৎসায় অন্তর্ভুক্ত ৮৭%)
- নারী যৌনকর্মী: ১,১৩,২২৪ জন (শুধু ২৩% চিকিৎসার আওতায়)
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই জনগোষ্ঠীকে সেবা ও নজরদারির বাইরে রাখলে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
🟦 রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতেও মিলছে নতুন রোগী
মিয়ানমারে এইচআইভির হার তুলনামূলক অনেক বেশি হওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যেও রোগী শনাক্ত বাড়ছে। এ পর্যন্ত ১,৩৪২ জন রোহিঙ্গা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৪২ জন চিকিৎসার আওতায়।
🟧 কারাগারেও এইচআইভির উপস্থিতি
২০২২ সাল থেকে দেশের ১২টি কারাগারে এইচআইভি, সিফিলিস ও হেপাটাইটিস-সি শনাক্ত কার্যক্রম চালু রয়েছে।
জানুয়ারি–অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত এ কার্যক্রমে ৮,৯৫১ জনের পরীক্ষা করে ১৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
📉 গ্লোবাল ফান্ডের সহায়তা কমলে কী হবে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর স্বীকার করেছেন—
“আমাদের মানবসম্পদ কম, লজিস্টিকস কম, এনজিওর অংশগ্রহণও কমে গেছে। ডিসেম্বরের পর অর্থায়ন কমে গেলে লক্ষ্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়বে।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন—প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম থেমে গেলে দেশের এইডস পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যেতে পারে।