জুলাই গণঅভ্যুত্থয়ের সময় সংঘটিত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুইটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরেকটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মোর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এ ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। অন্যান্য সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত
ট্রাইব্যুনাল জানায়, পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটি অভিযোগই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
— এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
— এবং একটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং প্রাক্তন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে সহযোগিতা করায় ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামুনই এ মামলার একমাত্র গ্রেফতার আসামি।
চানখারপুলে ৬ জনকে হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
ট্রাইব্যুনাল বলেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট চানখারপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয়জনকে হত্যা করার ঘটনায় শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা ছিলেন। এ অভিযোগেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
রায় ঘোষণার সময় আদালত প্রাঙ্গণে নিহতদের পরিবার ও জুলাই আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীরা উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর তাদের অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলে অ্যাটর্নি জেনারেল তাদের শান্ত থাকতে অনুরোধ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ: ‘হাসিনা ছিলেন মাস্টারমাইন্ড’
মামলার শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষ বারবার দাবি করে যে—
জুলাই গণঅভ্যুত্থয়ের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর নেপথ্যে ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনিই নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী ও সর্বোচ্চ কমান্ডার।
মামলার পটভূমি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। নতুন ট্রাইব্যুনালেই জুলাই গণঅভ্যুত্থয়–সংক্রান্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম মামলা দায়ের করা হয়।
প্রথমে শেখ হাসিনা একমাত্র আসামি ছিলেন। পরে ২০২৫ সালের মার্চে আবেদন গ্রহণের মাধ্যমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং সাবেক আইজিপি মামুনকে এ মামলায় যুক্ত করা হয়।
রায়ে উল্লিখিত পাঁচ অভিযোগ
১️⃣ উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান
২️⃣ হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যায় নির্দেশ দেওয়া
৩️⃣ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাইদ হত্যায় প্ররোচনা ও সম্পৃক্ততা
৪️⃣ চানখারপুলে ৬ জনকে হত্যার নির্দেশ
5️⃣ আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ
৫৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি
মোট ৫৪ জন সাক্ষী—
আহত, প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসক ও আন্দোলন অংশগ্রহণকারীরা—ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ ছাড়াও অডিও–ভিডিও রেকর্ড, গণমাধ্যম রিপোর্ট, উদ্ধার করা গুলি ও ডিজিটাল প্রমাণ পেশ করা হয়।
১২ অক্টোবর যুক্তি–তর্ক শুরু হয়ে ২৩ অক্টোবর শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষ ওইদিনই হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দাবি করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি
রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল এলাকা, সুপ্রিম কোর্ট এবং আশপাশে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীও মোতায়েন রয়েছে।
১৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে দোয়েল চত্বর–শিক্ষাভবন রোডে চলাচল সীমিত করা হয়।